এ অধ্যায়ের শেষে আমরা ধারণা নিতে পারব - ■ শীল কী; ■ শীলের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি; ■ নানা প্রকার শীল; ■ অষ্টশীল পরিচিতি; ■ অষ্টশীল প্রার্থনা ও ■ অষ্টশীল পালনের সুফল। |
শ্রেণিকক্ষে ঢুকেই শিক্ষক দেখলেন, খুব উৎফুল্ল পরিবেশ। সবাই বেশ হৈ চৈ করছে। হাতের ইশারায় সবাইকে থামিয়ে আনন্দের কারণ জানতে চাইলেন। সুকন্যা দাঁড়িয়ে বললো, আর দুদিন পরেই প্রবারণা পূর্ণিমা। আমরা ঠিক করেছি সবাই মিলে বিহারে যাবো এবং শীল গ্রহণ করব।
তা শুনে শিক্ষক বললেন, বাহ্ বেশ তো, আমিও যাবো। আচ্ছা, ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমরা তো শীল পড়েছিলাম, মনে আছে? সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, হ্যাঁ মনে আছে। তাহলে সবাই মিলে শীল বিষয়ে একটি ধারণা প্রবাহচিত্র তৈরি করো, যেখানে শীলের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, গুরুত্ব প্রভৃতির ধারণা থাকবে।
অংশগ্রহণমূলক কাজ : ১২
শীল সম্পর্কে একটি ধারণা প্রবাহচিত্র তৈরি করো।
উপরের চার্ট থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি নানা প্রকার শীল আছে। পঞ্চশীল সম্পর্কে আমরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েছি। এবার আমরা অষ্টশীল সম্পর্কে জানব। এরপর তিনি অষ্টশীল সম্পর্কে বলতে শুরু করেন।
ধর্মময় উৎকৃষ্ট জীবন গঠনের জন্য বুদ্ধ উপোসথ প্রবর্তন করেছিলেন। উপোসথ ভিক্ষু এবং গৃহী উভয়ের পালনীয় একটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। বৌদ্ধরা পূর্ণিমা, অমাবস্যা এবং অষ্টমী তিথিতে উপোসথ পালন করেন। ‘উপোসথ’ শব্দের সাধারণ অর্থ হলো উপবাস। কিন্তু বৌদ্ধধর্ম মতে, উপোসথ অর্থ কেবল উপবাস বা খাদ্য-দ্রব্য গ্রহণ হতে বিরতি বোঝায় না। উপবাসের সাথে শীল পালন, ধর্মানুশীলন, ধ্যান-সমাধি চর্চা এবং সংযত জীবনযাপন করতে হয়। তাই উপোসথের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। মাঝে মাঝে উপবাসের দ্বারা আহারের উপযোগিতা বোঝা যায়। দরিদ্র অভুক্ত মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করা যায়। এছাড়া, নৈতিক, মানবিক এবং ধর্মসম্মত পরিশুদ্ধ জীবন গঠন করা যায়। গৃহী বৌদ্ধরা অষ্টশীল গ্রহণের মাধ্যমে উপোসথব্রত পালন করেন। অষ্টশীল গ্রহণ করলে মধ্যাহ্ন ভোজনের পর পরদিন সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত খাওয়া যায় না। সূর্যোদয়ের পর খাবার গ্রহণ করা যায়। অষ্টশীল গ্রহণকারীরা পঞ্চশীলের সঙ্গে আরো অতিরিক্ত তিনটি শীল পালন করেন।
তবে পঞ্চশীলের তৃতীয় শীল - কামেসু মিচ্ছাচারা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিযামি, এর স্থানে অষ্টশীলে - অব্রহ্মচরিযা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিযামি - বলতে হয়। এর অর্থ সকল প্রকার অব্রহ্মচর্য কর্ম হতে বিরত থাকার শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। এই শীল প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে সাময়িকভাবে ব্রহ্মচর্য বা সন্ন্যাসব্রত পালন করা হয়।
অতিরিক্ত তিনটি শীলের মধ্যে ষষ্ঠ শীল - বিকালে ভোজন থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। মধ্যাহ্ন ভোজনের নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করে ভোজন করলে তা বিকাল-ভোজন বলে ধরে নেয়া হয়। বিকালে খেলে নানা শারীরিক অসুস্থতা এবং অলসতা বৃদ্ধি পায়। ফলে সংযম সাধনায় বাধা আসে । তাই খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে সংযত থাকার অভ্যাস করা হয়।
সপ্তম শীলটি নাচ-গান-বাদ্যযন্ত্রের উৎসব দর্শন করা, ফুল-মালা-সুগন্ধি ও অলঙ্কার পরিধান প্রভৃতি হতে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। কারণ এর দ্বারা মন চঞ্চল হয়, মনে লোভ-তৃষ্ণা জাগ্রত হয়। ফলে চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। সংযত আচরণে বিঘ্ন ঘটে।
অষ্টম শীল, উচ্চশয্যা ও মহাশয্যা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। অর্থাৎ দামী সুসজ্জিত আরামদায়ক শয্যায় বা বিছানায় শয়ন এবং আসন গ্রহণ করলে আরামপ্রিয়তা ও অলসতা বৃদ্ধি পায়। ভোগের প্রতি আসক্তি জন্মে। এতে আরো লোভ-তৃষ্ণা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অষ্টশীল গ্রহণের আগে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হয়। সাধারণত বিহারে ভিক্ষুকে বন্দনা নিবেদন করে অষ্টশীল প্রার্থনা করতে হয়। ভিক্ষু অষ্টশীল প্রার্থনা অনুমোদন করে ত্রিশরণসহ অষ্টশীল প্রদান করেন এবং শ্রদ্ধাবান উপসক-উপাসিকাগণ তা গ্রহণ করেন। তবে নিজ বাড়িতেও অষ্টশীল গ্রহণ করা যায়। সে ক্ষেত্রে বুদ্ধাসনের সামনে বসে নিজে নিজে অষ্টশীল প্রার্থনাসহ অষ্টশীল গ্রহণ করতে হয়।
অংশগ্রহণমূলক কাজ : ১৩
তোমার অথবা পরিবারের কারো অষ্টশীল পালন করার ঘটনা বা অভিজ্ঞতাটি লেখো
অষ্টশীল প্রার্থনা
অষ্টশীল গ্রহণের আগে ভিক্ষুর কাছে অষ্টশীল প্রার্থনা করতে হয়। প্রার্থনাটি এ রকম :
ওকাস অহং ভন্তে তিসরণেনসহ অটঠাঙ্গসমন্নাগতং উপোসথ-সীলং ধম্মং যাচামি, অনুজ্ঞহং কত্বা সীলং দেথ মে ভন্তে। দুতিযম্পি ওকাস অহং ভন্তে তিসরণেনসহ অষ্টাঙ্গসমন্নাগতং উপোসথ-সীলং ধম্মং যাচামি, অনুজ্ঞহং কত্বা সীলং দেথ মে ভন্তে। ততিযম্পি ওকাস অহং ভন্তে তিসরণেনসহ অৰ্চ্চাঙ্গসমন্নাগতং উপোসথ-সীলং ধম্মং যাচামি, অনুজ্ঞহং কত্বা সীলং দেথ মে ভন্তে। |
এখানে জেনে রাখা প্রয়োজন যে, একজন প্রার্থনা করলে ‘ অহং' ও 'যাচামি' এবং বহুজনে করলে ‘ময়ং’ ও ‘যাচাম’ হবে।
অষ্টশীল প্রার্থনার বাংলা অনুবাদ
ভন্তে অবকাশপূর্বক (ভন্তে আপনার অবসর হলে ) সম্মতি প্রদান করুন। আমি ত্রিশরণসহ অষ্টশীল ধর্ম প্রার্থনা করছি। ভন্তে দয়া করে আমাকে শীল প্রদান করুন। দ্বিতীয়বার ভন্তে অবকাশপূর্বক (ভন্তে আপনার অবসর হলে ) সম্মতি প্রদান করুন। আমি ত্রিশরণসহ অষ্টশীল ধর্ম প্রার্থনা করছি। ভন্তে দয়া করে আমাকে শীল প্রদান করুন। তৃতীয়বার ভন্তে অবকাশপূর্বক (ভন্তে আপনার অবসর হলে ) সম্মতি প্রদান করুন। আমি ত্রিশরণসহ অষ্টশীল ধর্ম প্রার্থনা করছি। ভন্তে দয়া করে আমাকে শীল প্রদান করুন। |
ভিক্ষু: যমহং বদামি তং বদেথ (আমি যা বলছি তা বলুন)।
শীল গ্রহণকারী : আম ভন্তে (হ্যাঁ ভন্তে বলছি)
ভিক্ষু : নমো তস্র ভগবতো অরহতো সম্মাসম্বুদ্ধস্স ( তিনবার বলতে হবে)।
এরপর ভিক্ষু ত্রিশরণ গ্রহণ করতে বলবেন।
ত্রিশরণ প্রার্থনা : পালি ও বাংলা
বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি (আমি বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করছি)। ধম্মং সরণং গচ্ছামি (আমি ধর্মের শরণ গ্রহণ করছি)। সংঘং সরণং গচ্ছামি (আমি সংঘের শরণ গ্রহণ করছি)। দুতিযম্পি বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি (আমি দ্বিতীয়বার বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করছি)। দুতিযম্পি ধম্মং সরণং গচ্ছামি (আমি দ্বিতীয়বার ধর্মের শরণ গ্রহণ করছি)। দুতিযম্পি সংঘং সরণং গচ্ছামি (আমি দ্বিতীয়বার সংঘের শরণ গ্রহণ করছি)। ততিযম্পি বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি (আমি তৃতীয়বার বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করছি)। ততিযম্পি ধম্মং সরণং গচ্ছামি (আমি তৃতীয়বার ধর্মের শরণ গ্রহণ করছি)। ততিযম্পি সংঘং সরণং গচ্ছামি (আমি তৃতীয়বার সংঘের শরণ গ্রহণ করছি)। |
ভিক্ষু: সরণা গমনং সম্পন্নং ( শরণে গমন বা শরণ গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে)।
শীল প্রার্থনাকারী: আম ভন্তে (হ্যাঁ ভন্তে) ।
এরপর ভিক্ষু অষ্টশীল প্রদান করবেন এবং শীল গ্রহণকারী তা মুখে মুখে বলবেন।
অষ্টশীল (পালি)
পাণাতিপাতা বেরমণী সিন্ধাপদং সমাদিযামি। অদিন্নাদানা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিযামি। অব্রহ্মচরিযা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিয়ামি। মুসাবাদা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিয়ামি। সুরা-মেরেয-মজ্জ পমাদষ্ঠানা বেরমণী সিন্ধাপদং সমাদিয়ামি। বিকাল-ভোজনা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিয়ামি। নচ্চ-গীত-বাদিত বিসূক দস্পন-মালাগন্ধ-বিলেপন-ধারণ- মন্ডন-বিভূসনটঠাআনা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিয়ামি। উচ্চসযন-মহাসযনা বেরমণী সিস্থাপদং সমাদিযামি। |
অষ্টশীল (বাংলা)
আমি প্রাণিহত্যা থেকে বিরত থাকবো, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। আমি অদত্তবস্তু গ্রহণ থেকে বিরত থাকবো, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। আমি অব্ৰহ্মচর্য থেকে বিরত থাকবো, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। আমি মিথ্যাকথা বলা থেকে বিরত থাকবো, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। আমি সুরা এবং মাদকজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকবো, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। আমি বিকালে ভোজন থেকে বিরত থাকবো, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। আমি নাচ-গান-বাদ্য উৎসব দর্শন, সুগন্ধিযুক্ত প্রসাধন দ্রব্য ধারণ মন্ডন বিভূষণ থেকে বিরত থাকব, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। আমি উচ্চশয্যা ও মহাশয্যা (অত্যন্ত আরামদায়ক শয্যা ) থেকে বিরত থাকবো, এ শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি। |
অংশগ্রহণমূলক কাজ : ১৪
অষ্টশীল গ্রহণের প্রক্রিয়াটি সবাই মিলে ভূমিকাভিনয় করো।
অংশগ্রহণমূলক কাজ : ১৫ অষ্টশীল গ্রহণ করার পরে তোমার অভিজ্ঞতাটি নিচে শিখন প্রতিফলনে লেখো। শিখন প্রতিফলন ১. অষ্টশীল গ্রহণের প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে লেখো। |
২. অষ্টশীল গ্রহণের অভিজ্ঞতার অনুভূতি লেখো । |
৩. অষ্টশীল পালনের ফলে তুমি কী সুফল পেয়েছ তা লেখো। |
অষ্টশীল সম্পর্কে বলার পর শিক্ষক অষ্টশীল পালনের সুফল সম্পর্কে আলোচনা করেন। নিচে অষ্টশীল পালনের সুফল বর্ণনা করা হলো।
অষ্টশীল পালনের সুফল
অষ্টশীল পালনের সুফল অনেক। অবিদ্যার কারণে মানুষের মধ্যে তৃষ্ণা বা আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়। তৃষ্ণা বা আকাঙ্ক্ষার কারণেই লোভের জন্ম হয়। লোভের বশর্তী হয়ে মানুষ নানা রকম অসৎ কর্মে জড়িয়ে পড়ে। ফলে নানারকম দুঃখ ভোগ করে। অষ্টশীল পালনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সংযম, সততা, শৃঙ্খলা, নম্রতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য্য প্রভৃতি গুণাবলির বিকাশ ঘটে। লোভ-তৃষ্ণা দূরীভূত হয়। আত্মসংযম ও সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায়। নীরোগ ও দীর্ঘ জীবন লাভ হয়। ধর্ম চেতনা জাগ্রত হয় এবং ধর্ম সম্মত জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ হয়। এছাড়া, নৈতিক ও মানবিক জীবন গঠন করা যায়। পারিবারিকভাবে অষ্টশীল পালনের অভ্যাস গড়ে তুললে পারিবারিক জীবনও সুখের হয়। তাই সকলের অষ্টশীল গ্রহণ করা উচিত।
এরপর, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অষ্টশীল পালনের উপদেশ দিয়ে পাঠ শেষ করেন।
Read more